ব্রেকিং

x

জার্মানির মাটিতে দেশীয় আমেজে কোরবানীর ঈদ ও কোরবানী

বুধবার, ২৮ জুন ২০২৩ | 9 বার

জার্মানির মাটিতে দেশীয় আমেজে কোরবানীর ঈদ ও কোরবানী
জার্মানির মাটিতে দেশীয় আমেজে কোরবানীর ঈদ ও কোরবানী

সারা বিশ্বের মত জার্মানিতেও উদযাপন করা হলো কোরবানির ঈদ। সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ উদযাপন পালন করা হয় । সৌদি আরবের সাথে মিল বলে বাংলাদেশের একদিন আগে জার্মানিতে ঈদ হয়।

জার্মানিতে বসবাসরত বাঙ্গালী ডাঃ এম কে কবির এর ফেসবুক পেইজ থেকে আমাদের পাঠকদের জন্য তুলেধরলাম এবারের ঈদ উদযাপন :

আজ বুধবার ভোর ৫:৩০ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে, শাওয়ার নিয়ে রেডি হলাম। রেডি হতে হতে ৬:১৫ বেজে গেলো। এরপর গেলাম কাছেই একটা মরোক্কান মসজিদে। সকাল ৭:০০ টায় জামাত। গিয়ে হাজারো মানুষের সাথে মিলিত হলাম জামাতে। মসজিদের ভিতরে ভর্তি হয়ে আছে। পাশের রাস্তাও মুসল্লিতে পরিপূর্ণ ঈদ জামাতে অংশ নেবার জন্যে। মনে হয় ঢাকা শহরের কোনো মসজিদে এসেছি!
নামাজ শেষে কয়েকজন বাংলাদেশী পরিচিতজনদের সাথে কোলাকুলি করলাম।

এবার বাংলাদেশী মসজিদ রেখে মরোক্কান মসজিদে ঈদ জামায়াত করলাম এই জন্যে যে, আমায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার যেতে হবে কুরবানী দিতে। সেখানে সকাল ৯:৩০ টার ভিতরে থাকতে হবে কোরবানির জন্যে। আর বাংলাদেশী মসজিদ এ প্রথম জামায়াত হবে সকাল ৮:৩০ টায় যেটা কিনা আমার জন্যে বেশি দেরি হয়ে যাবে।

ঈদ এর নামাজ শেষ করে রওনা দিলাম কোরবানি দিতে। একটু দূরের জায়গায় কোরবানি ঠিক করেছি এই জন্যে যে, ওখানে ঈদ এর দিনই কোরবানি দেয়া এবং মাংস পাওয়া যাবে।

কোরবানি ডয়েচল্যান্ড (Deutschland) বা জার্মানী গ্রুপ:

জার্মানিতে তুর্কিশরা সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি হওয়াতে ওরা অনেকেই এক সাথে অনেক জায়গায় কোরবানি দেয়। যার ফলে তারা কোরবানির দিনই কোরবানি দিয়ে মাংস নিতে পারে। এই জিনিসটা থেকে আমার মনে হলো আমরাও যদি বাংলাদেশিদের একটা গ্রুপ বানাতে পারি, তা হলে আমাদের টোটাল গরুর পরিমান বেশি হবে এবং সংখ্যাগরিষ্টতা সুবাদে আমরাও ঈদ এর দিন কোরবানি দিতে পারবো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। সেই কথা চিন্তা করে পরিচিত বাংলাদেশিদের নিয়ে আমি একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ বানালাম। আমরা এই গ্রুপ এ আপাতত ৮৪ জন বাংলাদেশী আছি। এই বছর আমরা আমাদের গ্রুপ থেকে ১২ টি গরু কোরবানি দিয়েছি। সামনে ইনশাল্লাহ আমরা এই গ্রুপে আরো অনেক বেশি হব সংখ্যাতে।

কিভাবে কুরবানী গরু ঠিক হয়:

জার্মানিতে যেখানে সেখানে কুরবানী দেয়া যায় না। কুরবানী দেবার জন্যে কিছু এলাকা থাকে যেখানে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য সম্মতভাবেই কোরবানি দিতে হয়। এই জায়গাটাকে বলে শ্লাচথফ (Schlachthof) বা কোরবানির জায়গা। ঈদ এর এক থেকে দুই মাস আগে জার্মানিতে শ্লাচথফ (Schlachthof) এর মালিকের কাছে যোগাযোগ করে গরু রিজারভেশন দিতে হয়। শ্লাচথফ (Schlachthof) এর মালিক হয়তোবা নিজে এই গরুগুলি পালে অথবা লোকালি বিভিন্ন কৃষকের কাছ থেকে অথবা হল্যান্ড বা আশে-পাশের দেশ থেকে কিনে আনে। আমার কাছে বেশি ভালো লাগে মালিক যেটা নিজে পালে বা লোকাললী কিনে ওই গরুর মাংস।

শ্লাচথফ (Schlachthof) এর মালিক গরু আনার পর খবর দেয় গরু দেখার জন্যে। সাধারণত কোরবানির ২-৩ সপ্তাহ আগে গিয়ে গরু দেখে পছন্দ করে আসা যায়। আমি সাধারণত একটু ছোট সাইজ এর গরু পছন্দ করি। ছোট সাইজ এর গরু সচরাচর কচি হয়, খেতে মজা।

গরুর দর-দাম:

কোরবানির এক থেকে দুই দিন আগে ওই গরুর ওজন করে জানিয়ে দেয়া হয় কত দাম পড়বে। এবার আমি যে গরু কোরবানি দিচ্ছি এটার ওজন (সম্পূর্ণ গরু) হলো ৬২০ কেজি। আমরা ৭ জন বাংলাদেশী মিলে এই গরুটা কোরবানি দিচ্ছি। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ধরা হয়েছে ৩.৪০ ইউরো করে। এই গরু থেকে নেট মাংস পাওয়া গিয়েছে ৩৩০ কেজি এর মতো। তার মানে প্রতি কেজি এর দাম পরে প্রায় ৬.৪০ ইউরো যা কিনা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৭১৫ টাকা করে হয়। তার মানে কোরবানির জন্যে প্রতিজন প্রায় ৩১০ ইউরো বা ৩৭,০০০ বাংলাদেশি টাকা খরচ করেন। আমি হিসেবটা এই জন্যেই আপনাদের দিলাম যাতে আপনারাও জার্মানিতে এসে কুরবানী দিতে চাইলে খরচটার ব্যাপারে ধারণা করতে পারেন।

গরু কুরবানীর সময়:

আমাদের গরুর কোরবানির সময় আসতে আসতে বেলা প্রায় ১১:৩০ টা হয়ে গিয়েছে। যখন আমার গরুর কোরবানির সময় আসছে তখন শ্লাচথফ (Schlachthof) এর মালিক আমাদের কাছে এসে টাকাটা বুঝে নেয় আর ভিতরে যেতে দেয় যেখানে ইমাম সাহেব গরু জবাই করবে।

গরু জবাই করার আগে পশু ডাক্তার গরু টেস্ট করে রিপোর্ট দেয় যে গরুতে কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। জবেহ দেবার আগে কোরবানিদাতা সবার নাম ইমাম সাহেবের হাতে দেয়া হয়। উনি ওটা পড়ে সবাইকে শুনিয়ে ছোট্ট দোআ করেন, আর বলেন আল্লাহ, ওনাদের কোরবানি তুমি কবুল করো! এর পর পরই গরু ওখানে হাজির হয়। ইমাম সাহেব “আল্লাহ আকবার” বলেন। আমরা যারা ওখানে থাকি তারাও সমস্বরে “আল্লাহু আকবার” বলি। ইমাম সাহেব ছুড়ি দিয়ে জবাই করে দেন!

 

 

মাংস প্রসেস:

কুরবানীর পর ওই গরুর মাংস ভিতরেই শ্লাচথফ (Schlachthof) এর মালিক কাটান। একেকটা গরুর মাংস প্রসেস করতে তাদের ১৫ মিনিট সময় লাগে। তারপর যত ভাগ হবার কথা অতটা ভাগ করে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। ওখানে মাংস আর হাড় দেয়া হয়। এখানে জার্মানিতে গরুর মগজ দেয়া হয় না, কারণ জার্মানিতে ডাক্তারি মতে এটা নিষেধ। আমরা নিজেরা বাস্কেট নিয়ে যাই। ওটাতে ভরে নিয়ে চলে আসি।

বাংলাদেশিদের মিলন মেলা:

শ্লাচথফ (Schlachthof) এ যাবার পর মাংস পাবার আগ পর্যন্ত যেই ৪-৬ ঘন্টা থাকে ওই সময়টা আমরা বাংলাদেশিরা বসে গল্প করি। সবাই একেক রকম খাবার নিয়ে যায়। সবাই আমরা সবারটা খাই। খুব মজা!
আজকে কেউ এনেছেন ফ্রেশ মিষ্টি, কেউ ফ্রেশ পিজা, কেউ তরমুজ, ঝালমুড়ি,চটপটি, আরো কত-কি। সেই সাথে চা-কফি তো আছেই লেগে।

মাংস আনা এবং ভাগ ভাটোয়ারা:

সাধারণত মাংসগুলি একটু বড় সাইজ এর হয় (একেক পিস্ ৮০০-১২০০ গ্রাম এর মতো)। মাংস আনার পর ওটাকে একটু প্রসেস করে ভাগ করি। তারপর পরিচিত দেশি-বিদেশী অনেকের বাসায় গিয়ে গিয়ে দিয়ে আসি। আমাদের দেশি যারা আছেন পরিচিত এবং ঘনিষ্ট তাদেরকে দিয়ে আসি প্রথমে। অন্য ধর্মের (যেমন খ্রীষ্টান) জার্মান যারা আমার পরিচিত বা প্রতিবেশী তাদেরকেও আমি মাংস দেই। আমাদের ধর্মে অন্য ধর্মের মানুষদের কোরবানির মাংস দেবার কথা বলা আছে (উত্তম)।
এই যে বিদেশের মাটিতে এসেও কোরবানির মাংস ভাগ করি, এটা অনেক বেশি ভালো লাগে!

উপসংহার:
একজন বাংলাদেশী মুসলমান হিসেবে জার্মানিতে এসে এভাবে কোরবানি দেয়া এবং মানুষের মধ্যে বিলি-বন্টন করা অনেক ভালো লাগে। বিশেষ করে প্রধানত ক্রিস্টান ধর্মের জার্মানদের মধ্যে এভাবে মাংস দেবার পর ওরা অনেক খুশি হয়। জার্মানরা জিজ্ঞেস করে, কি কারণে মাংস দিচ্ছি। বলি তখন, আমাদের ইসলাম ধর্মীয় নিয়মে কোরবানি দিচ্ছি। এবং তারা যেহেতু আমার পরিচিত/প্রতিবেশী এবং আমার ধর্ম বলে অন্য ধর্মের মানুষদেরকে দেয়াও উত্তম, তখন কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি “তোমাদের মুসলিম ধর্ম তো দেখি অনেক দারুন অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতিও!” তখন মনের ভিতরটাতে অনেক খুশি লাগে।

আসুন আমরা যার যার ধর্মের ভালো ভালো জিনিসগুলি দিয়ে এই পৃথিবীতে সবাই মিলে-মিশে সুন্দর এবং সুখী-ভাবে এক সাথেই বসবাস করি! যত বেশি সুন্দর, অসুন্দরের জায়গা তত কম!

 

লেখক : ডাঃ এমকে কবির

Development by: webnewsdesign.com